অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেছেন, বর্তমানে একতা ও আধ্যাত্মিকতা সাম্রাজ্যবাদ ও ইহুদিবাদের পক্ষ থেকে আগের চেয়ে অনেক বেশি শত্রুতা ও ষড়যন্ত্রের শিকার। আমেরিকাসহ সাম্রাজ্যবাদের কেন্দ্রগুলো মুসলমানদের ঐক্য, মুসলিম জাতি, দেশ ও সরকারগুলোর সমঝোতা, এসব জাতির তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ধর্মানুরাগের কঠোর বিরোধী এবং তারা যেকোনো উপায়ে তা মোকাবেলা করছে।
তিনি আরও বলেন, সাম্রাজ্যবাদ ও ইহুদিবাদ যেসব পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সেগুলোকে বাতিল ও অকার্যকর করে দিতে পারে এই হজ্ব। সর্বোচ্চ নেতা বলেন, “আমাদের সবার অর্থাৎ সব জাতি ও সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে আমেরিকা ও ইহুদিবাদীদের এই শয়তানি চক্রান্তের মোকাবেলায় প্রতিরোধ গড়ে তোলা।” এবারের পবিত্র হজ্ব উপলক্ষে দেওয়া বাণীতে এসব কথা বলেন। তাঁর এই হজ্ববাণী আজ প্রকাশিত হয়েছে।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতার পূর্ণাঙ্গ হজ্ববাণী
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
ওয়ালহামদুলিল্লাহি রব্বিল আলামিন ওয়া সাল্লিয়ালা আলার্ রাসুলিল আজাম মুহাম্মাদিল মুস্তাফা ওয়া আলিহিত তাইয়িবিন ওয়া সাহবিহিল মুন্তাজাবিন
ইব্রাহিমি হজ্বের ডাক ও এর বিশ্বজনীন আহ্বান আবারও ইতিহাসের হৃদয় থেকে গোটা বিশ্বকে সম্বোধন করছে এবং আল্লাহকে স্মরণকারী সচেতন ও সজাগ মানুষের হৃদয় উৎসাহিত ও উদ্দীপ্ত হচ্ছে। আহ্বানকারীর এই এই আহ্বান গোটা মানব জাতির জন্য: ‘আর মানুষের মাঝে হজ্বের ঘোষণা দাও…’ (পবিত্র কুরআন ২২:২৭ একাংশ) এবং কাবা সব মানুষের জন্য পবিত্র আয়োজক ও পথপ্রদর্শক: ‘মক্কাতেই মানবজাতির জন্য সর্ব প্রথম ঘর তৈরি হয়েছিল। ঐ ঘর বিশ্ববাসীদের জন্য হেদায়াত ও বরকতের উৎস।’ (পবিত্র কুরআন ৩:৯৬)
কাবা শরিফ মুসলমানদের মনোযোগের প্রধান মূল স্থান ও কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে এবং পবিত্র হজ্বের অনুষ্ঠান বৈচিত্রময় মুসলিম বিশ্বের ছোট্ট একটা নমুনা বা প্রদর্শনী হিসেবে গোটা মানব সমাজ এবং বিশ্বের সব মানুষের শান্তি-স্বস্তি ও নিরাপত্তা বিধানে ভূমিকা রাখতে পারে। হজ্ব সমগ্র মানবতার আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও আত্মিক উন্নতি সাধন করতে পারে; বর্তমানে মানবজাতির জন্য এটা অত্যাবশ্যক।
বর্তমানে ও ভবিষ্যতে মানবজাতির মধ্যে নৈতিক অধঃপতন ঘটানোর জন্য সাম্রাজ্যবাদ ও ইহুদিবাদ যেসব পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সেগুলোকে বাতিল ও অকার্যকর করে দিতে পারে এই হজ্ব। এ জন্য প্রয়োজনীয় শর্ত হচ্ছে মুসলমানদেরকে প্রথমে হজ্বের জীবনীদায়ক আহ্বান সঠিকভাবে শুনতে হবে এবং তা বাস্তবায়ন করতে সর্বাত্মক চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এই আহ্বানের দু’টি প্রধান ভিত্তি হচ্ছে- একতা ও আধ্যাত্মিকতা। মুসলিম বিশ্বের বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক উন্নতি এবং গোটা বিশ্বকে আলোকিত করার গ্যারান্টি হচ্ছে এই ঐক্য ও আধ্যাত্মিকতা।
ঐক্য মানে চিন্তা ও বাস্তবতার মধ্যে সংযোগ; এর অর্থ হৃদয়-মন, চিন্তা-চেতনা এবং অবস্থান ও উদ্দেশ্য কাছাকাছি হওয়া। এর অর্থ বিজ্ঞান ও অভিজ্ঞতার মধ্যে সমন্বয়; এর অর্থ মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক সংযোগ; এর অর্থ মুসলিম সরকারগুলোর মধ্যে আস্থা ও সহযোগিতা; এর অর্থ অভিন্ন ও সন্দেহাতীত শত্রুদের মোকাবেলায় সহযোগিতা।
ঐক্যের অর্থ হলো শত্রুরা তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী মুসলিম বিশ্বের নানা সম্প্রদায়, মত, বর্ণ, ভাষা এবং সংস্কৃতিকে একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে পারবে না। ঐক্যের অর্থ হলো মুসলিম দেশগুলো পারস্পরিক যোগাযোগ, আলোচনা এবং যাতায়াতের মাধ্যমে পরস্পরকে চিনবে ও পরস্পরের সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে জানতে পারবে এবং এসব সুযোগ-সুবিধাকে কাজে লাগানোর জন্য পরিকল্পনা তৈরি করবে। এমনটি ঘটবে না যে, মুসলমানেরা শত্রুদের দেখানো বিদ্বেষ সৃষ্টির পন্থায় নিজেদেরকে চিনবে ও জানবে।
ঐক্য মানে মুসলিম বিশ্বের বিজ্ঞানী ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরস্পরের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে; বিভিন্ন মাজহাবের আলেমরা সৎ চিন্তা-বিশ্বাস, সহিষ্ণুতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে পরস্পরকে বিচার-বিবেচনা করবে এবং একে অপরের বক্তব্য শুনবে, প্রত্যেক দেশ ও প্রত্যেক মাজহাবের মনীষী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বরা জনগণকে পরস্পরের অভিন্ন বিষয়গুলোর সঙ্গে পরিচিত করাবে এবং পারস্পরিক সহাবস্থান ও ভ্রাতৃত্বের জন্য উৎসাহ দেবে।
ঐক্যের অর্থ হলো মুসলিম দেশগুলোর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্বরা পরস্পরের মধ্যে সমন্বয়ের ভিত্তিতে আসন্ন নয়া বিশ্ব ব্যবস্থার জন্য নিজেদেরকে প্রস্তুত করবে যাতে সম্ভাবনা ও সমস্যায় পরিপূর্ণ নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় মুসলিম উম্মাহ নিজের ইচ্ছায় সঠিক জায়গাটি হস্তগত করতে পারে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিম এশিয়ায় পাশ্চাত্যের সরকারগুলোর মাধ্যমে রাজনৈতিক ও ভূখণ্ডগত ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে তার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে।
আধ্যাত্মিকতা মানে ধর্মীয় নৈতিকতার উন্নয়ন। ধর্মহীন নৈতিকতার যে বিভ্রম বহু দিন ধরে পাশ্চাত্যের বুদ্ধিবৃত্তিক সূত্রগুলোর পক্ষ থেকে ছড়ানো হচ্ছিল তার পরিণতি হচ্ছে পাশ্চাত্যে নৈতিকতার অনিয়ন্ত্রিত পতন যা বর্তমানে গোটা বিশ্ব প্রত্যক্ষ করছে। আধ্যাত্মিকতা ও নৈতিক শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে হজের আচার-অনুষ্ঠান, ইহরাম অবস্থায় সাদাসিধা জীবনাচার, অলীক সুবিধা অস্বীকার, ‘…দুস্থ-দরিদ্রকে খেতে দাও’ (পবিত্র কুরআন ২২:২৮ একাংশ), ‘…হজে স্ত্রী সহবাস, পাপ কাজ ও ঝগড়া-বিবাদ বৈধ নয়’ (পবিত্র কুরআন ২:১৯৭ একাংশ), তাওহিদ বা একত্মবাদকে কেন্দ্র করে গোটা মুসলিম উম্মাহর প্রদক্ষিণ, শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ এবং মুশরিকদের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ থেকে।
প্রিয় হজ্ব পালনকারী ভাই ও বোনেরা,
এই অনন্য দায়িত্বের রহস্য ও চাবিকাঠি নিয়ে গভীর চিন্তা ও অন্বেষণ করার জন্য হজের সুযোগের সদ্ব্যবহার করুন এবং এটিকে আপনার বাকি জীবনের জন্য অবলম্বন করুন। বর্তমানে একতা ও আধ্যাত্মিকতা সাম্রাজ্যবাদ ও ইহুদিবাদের পক্ষ থেকে আগের চেয়ে অনেক বেশি শত্রুতা ও ষড়যন্ত্রের শিকার। আমেরিকাসহ সাম্রাজ্যবাদের কেন্দ্রগুলো মুসলমানদের ঐক্য, মুসলিম জাতি, দেশ ও সরকারগুলোর সমঝোতা, এসব জাতির তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ধর্মানুরাগের কঠোর বিরোধী এবং তারা যেকোনো উপায়ে তা মোকাবেলা করছে। আমাদের সবার অর্থাৎ সব জাতি ও সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে আমেরিকা ও ইহুদিবাদীদের এই শয়তানি চক্রান্তের মোকাবেলায় প্রতিরোধ গড়ে তোলা।
সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করুন, মুশরিকদের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের চেতনাকে জোরদার করুন এবং আপনার পরিবেশে তা প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করাকে নিজের দায়িত্ব বলে মনে করুন।
আমি ইরানি এবং অ-ইরানি সব হাজীর হজ্ব যাতে আল্লাহ কবুল করেন ও তারা সফল হতে পারেন সেজন্য সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে দোয়া করছি এবং সকলের জন্য হজরত বাকিয়াতুল্লাহিল আজমের (ইমাম মাহদি আলাইহিস সাল্লাম) দোয়া কামনা করছি-তাঁর জন্য আমাদের আত্মা উৎসর্গ হোক।
ওয়াস সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ
৬ জিলহজ্ব, ১৪৪৪ (২৫ জুন, ২০২৩)
Leave a Reply